দেখার চোখ, বুঝার চোখ
- ডা. আফরোজ হেলালী
- Aug 23, 2022
- 4 min read
আমরা অনেকেই বলিউড অভিনেতা আমির খান অভিনীত "তারে জামিন পার" সিনেমাটা দেখেছি। এই সিনেমাতে আট বছর বয়সী ইশান পড়াশোনায় ভীষণ অমনোযোগী একজন বাচ্চা।খুব চঞ্চল। যে প্রায় বন্ধুহীন।শিক্ষক, সহপাঠীসহ অনেকের বুলির শিকার।এমনকি বাড়িতে তার বাবা সর্বক্ষণ তাকে বড়ভাইয়ের সাথে তুলনা করেন যে পড়ালেখায় অত্যন্ত ভালো। ইশান খুবই সংবেদনশীল একজন বাচ্চা।তার সাথে হওয়া প্রতিটি আচরণ তাকে অনেক কষ্ট দেয় এবং সে দিনে দিনে আরও গুটিয়ে যায়, পড়ালেখায় খারাপ করতে থাকে। ইশান দারুণ ছবি আঁকে।মা ও ভাইয়ের সাথে তার যত খুনসুটি। একপর্যায়ে অনেকটা শাস্তিস্বরুপ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয় তাকে।এখানে একজন শিক্ষক ( আমির খান) আবিস্কার করেন ইশান একজন ডিজলেক্সিক বাচ্চা।তার লার্নিং এ সমস্যা আছে। যেহেতু ঐ শিক্ষক নিজেও ডিজলেক্সিক ছিলেন তাই তিনি ইশানের মনের কাছাকাছি গিয়ে তাকে বুঝে সবরকমের চেষ্টা করে ইশানকে পড়ালেখায় উদ্বুদ্ধ করেন এবং ইশানের পছন্দের কাজটাকে( আর্ট) আরো শানিত ও উৎসাহিত করেন।
"তারে জামিন পার" সিনেমা দেখে ইশানের সমস্যা ও কষ্টে চোখ ভেজেনি এমন মানুষ বিরল।কিন্তু এই সিনেমা থেকে কি আমরা কিছু শিখেছি?

"ডিসলেক্সিয়া (Dyslexia)" একটি গ্রীক শব্দ যার অর্থ "শব্দ সংক্রান্ত সমস্যা"।
"ডিসলেক্সিয়া" একটি লার্নিং ডিজঅর্ডার যেখানে বাচ্চা লিখতে ও পড়তে বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হয়। বাচ্চার ভাষা শেখার ও ব্যবহার করার মূল দক্ষতা অর্জনে সমস্যা বা দেরী হয়।মূলত লেখা এবং কোন লিখিত অংশ পাঠোদ্ধার করার সময় বাচ্চার পক্ষে সঠিকভাবে ধ্বনি ও বর্ণের সমন্বয় করা সম্ভব হয় না।
কারণসমূহঃ
এটি একটি জন্মগত ত্রুটি।
ব্রেনের যে অংশটি ভাষা শেখার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে (Left hemisphere) সেই অংশে কোন আঘাত পেলে বা ব্রেইন ট্রমা থাকলে।
ব্রেইনের বিকাশে কোন সমস্যা থাকলে।
লক্ষনসমূহঃ
সাধারণত স্কুলে ভর্তি হবার আগে ডিসলেক্সিয়া ডায়াগনোসিস করা মুশকিল বা প্রকাশ পায় না।
একেকবয়সে বাচ্চার একেকরকম লক্ষন প্রকাশ পায়।
২-৫ বছর বয়সীঃ
কথা বলা শিখতে অনেক দেরী হওয়া।
সহজ ও ছোট শব্দগুলোও শিখতে,উচ্চারণ করতে ও মনে রাখতে সমস্যা হয়।
সহজ শব্দ উচ্চারণে সমস্যা ও ইনস্ট্রাকশান বুঝতে না পারা।
ডান/ বাম, উপর/ নীচ আলাদা করতে সমস্যা।
৫ বছর+
বয়স অনুযায়ী অক্ষর ও শব্দ শিখতে না পারা, উচ্চারণ করতে না পারা, মনে রাখতে না পারা, শব্দ গঠনের ব্যাপারগুলো বুঝতে অসুবিধা হওয়া।
কিছু বর্ণ উল্টো করে লেখা, এক বর্ণের জায়গায় অন্য বর্ণ লেখা যেমন, b কে d, m কে w, ইংরেজি 8 ও বাংলা ৪ গুলিয়ে ফেলা ইত্যাদি।
শব্দ গঠনের সময় ধ্বনির ক্রম অনুসরণ করতে না পারা যেমন, পটল কে পলট, আমার কে আরাম, top কে pot ইত্যাদি লেখা।
কিছু শুনে ফলো করতে পারা বা বোর্ডের লেখা দেখে লেখা অথবা পরিচিত শব্দের সঠিক বানানে ভুল করা।
বয়স অনুযায়ী অথবা একই বয়সের অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় ইমম্যাচিওরড, হাতের লেখা খারাপ,পেন্সিল বা কলম ধরতে অসুবিধা।
বয়স উপযোগী যুক্তি, বিচার-বিশ্লেষণ করতে না পারা।
রুপক অর্থ, পাজল, ধাঁধা না বোঝা।
পড়া ও লেখার ক্ষেত্রে অতি ধীরগতি, এই কাজগুলোর প্রতি তীব্র অনীহা, গড়িমসি, এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা। অল্পসময়ে ক্লান্ত হয়ে পড়া।
বইখাতা, বিছানা, ঘর গুছিয়ে রাখতে পারে না। ঠিকমত কাপড় পরতে পারে না।
খেলাধুলা করতে চায় না।কারো সঙ্গে মিশতে চায় না।
১৩+ এবং প্রাপ্ত বয়স্কঃ
শব্দ ভুলে যাওয়া, সঠিক শব্দের ব্যবহার করতে না পারা, ভুল উচ্চারণ করা।
সহজ অংক করতে সমস্যা হওয়া।
অমনোযোগ, নিয়ম মেনে না চলা।
কথার খেই হারিয়ে ফেলা, কোন ঘটনার বর্ণনায় ধারাবাহিকতা না থাকা।
মানুষের সামনে সবসময় নার্ভাস,আনমনা, অসাবধানী থাকা।
জোর করলে অতিরিক্ত রাগ,ক্ষোভ,জেদ, কান্নাকাটি করা।
পড়া বা লেখার কাজ শেষ করতে অস্বাভাবিক সময় নেয়া।
করণীয়ঃ
"ডিসলেক্সিয়া"একটি নিরাময় অযোগ্য সমস্যা। তবে বিভিন্ন উপায়ে এটার সাথে খাপ খাইয়ে সাফল্য আনা সম্ভব।যত ছোট বয়সে ডায়াগনোসিস করা যায় তত তাড়াতাড়ি সাফল্যের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
অভিভাবকদের করণীয়ঃ
শিশুর "ডেভেলপমেন্টাল মাইলস্টোন" সম্পর্কে জানুন।
প্রফেশনালদের সাহায্য নিয়ে বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যরা, শিশুকে বোঝার চেষ্টা করা ,তাকে উৎসাহ দেয়া
ধৈর্যের সাথে তার পাশে থাকা
ডিসলেক্সিয়া আক্রান্তদের জন্য বিভিন্নরকম সহায়ক বিশেষ উপায়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে লেখাপড়া শেখানো
শিশুর অন্যান্য গুণাবলির বিকাশ ঘটানো
শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর চেষ্টা করা
যে কোন ভালো কাজের জন্য প্রশংসা করা, অনুপ্রেরণা দেয়া
সর্বোপরি অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে তার ব্যবহার,আচরণ কোনকিছু নিয়ে তুলনা না করা।শাস্তি না দেয়া
পরিবারের অন্যান্য সদস্য,ভাই-বোনরা যেন শিশুটির সমস্যা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন এবং শিশুটির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেন
প্রয়োজনে লার্নিং ডিজএইবিলিটি কনসালটেন্ট, চাইল্ড সাইকোলজিস্টের সাহায্য নেয়া।
সমস্যা লুকিয়ে না রেখে খোলাখুলি শেয়ার করা এবং সাহায্য নেয়া।
স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের করণীয়ঃ
সাধারণত প্রাথমিক স্কুল বা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হবার পর শিশুর
"ডিসলেক্সিয়া" ব্যাপারটি শিক্ষক, অভিভাবকদের গোচরে আসে। অন্যান্য যে কোন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের মতই ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত শিশুদের প্রতি সমাজ, স্কুলের দায়িত্ব অপরিসীম। সঠিক দিকনির্দেশনা, সহায়ক প্রশিক্ষণ, সহযোগিতা, সহমর্মিতা নিয়ে এইসকল শিশুদের অন্যান্য শিশুদের মূল প্রবাহের সাথে একাত্মীকরণ করা খুবই জরুরি। ঠিকমত যত্ন এদেরকে জনশক্তিতে পরিণত করতে সহায়ক হবে।
প্রাথমিক স্কুল ও কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের সবধরনের "স্পেশাল লার্নিং ডিজএইবিলিটি" নিয়ে সম্যক ধারণা থাকা,প্রয়োজনীয় বিশেষ জ্ঞান, প্রশিক্ষণ থাকা খুবই জরুরি। আমাদের দেশে এ সংক্রান্ত শিক্ষা, জ্ঞান, প্রশিক্ষণ অতি নগন্য। শিশুর ডিসলেক্সিয়া বা অন্যান্য লার্নিং ডিজএইবিলিটি আছে কি না তা নির্ণয়ে এই পর্যায়ের শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
* শিক্ষকদের "লার্নিং ডিজএইবিলিটি" সংক্রান্ত শিক্ষা, জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দেয়া।
* ক্লাসের অন্যান্য বাচ্চাদের শিশুটির সমস্যা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দেয়া ও ব্যাখ্যা করা যাতে অবজ্ঞা, বুলির শিকার না হয় এবং বিশেষ শিশুটি নিজেকে যেন আলাদা না ভাবে।
* সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও ধৈর্যের সাথে শিশুটির পড়াশোনা, আচার-আচরণ শুধরে দেয়া, সাহায্য করা।
* শিশুর আত্মবিশ্বাস, মনোবল বাড়ানো।ছোট কোন সাফল্যেও প্রশংসা করা, অনুপ্রেরণা দেয়া।
* হোমওয়ার্ক না করতে পারলে, পড়া ভুলে গেলে অথবা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে শাস্তি না দেয়া।
* ক্লাসে সবার সামনে কিছু পড়তে দেয়া, তাড়াহুড়ো করে কাজটা শেষ করতে বলা, ভুল হলে বিরুপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা।
* আদর করে, আলাদা মনোযোগ দিয়ে পড়াটা বারবার মনে করিয়ে দেয়া, মনে রাখার বিভিন্ন উপায় শিখিয়ে দেয়া, সময় দিয়ে কাজটা আদায় করে নেয়া।
* সময় নিয়ে ছোট ছোট ধাপে সহজ ও পরিষ্কারভাবে নির্দেশনা দেয়া।
* নির্দেশনাগুলো ধৈর্য নিয়ে বুঝানো,পূনরাবৃত্তি করা।
* শিশুর মনোযোগ ও আগ্রহ বাড়াতে মজার মজার উপায়, ক্রিয়েটিভ ধারণা প্রয়োগ করা।
* শিশুটির অন্যান্য ভালো গুণগুলো বিকাশে উদ্বুদ্ধ করা।উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেয়া।
* প্রযুক্তির সাহায্য নেয়া।
* অভিভাবকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহমর্মী হওয়া।শিশুটির দৈনন্দিন কাজের, পড়াশোনার অগ্রগতির ব্যাপারে পারস্পরিক মতামত আদানপ্রদান, আলোচনা করা, দিক নির্দেশনা দেয়া।
ডিজলেক্সিক বাচ্চাদের বুদ্ধিমত্তা, দৃষ্টি বা শ্রবণশক্তিতে কোন ঘাটতি থাকে না। তবে ডিসলেক্সিয়া ও ADHD (Attention Deficit Hyperactivity Disorder) একসাথে থাকতে পারে। পৃথিবীর অনেক সফল ব্যক্তি ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।আইনস্টাইন, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, টমাস আলভা এডিসন, স্টিভ জবস, অভিষেক বচ্চন সহ অনেক বিখ্যাত মানুষ ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত ছিলেন।
প্রতিটি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর অধিকার আর দশটা সাধারণ বাচ্চার সমান।আলাদা যত্ন, বিশেষ মনোযোগ, সঠিক দিকনির্দেশনা, স্নেহ, আদর, ভালোবাসা, সহমর্মিতা, ধৈর্য এসব বাচ্চাদের জীবনের পথে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যাক, মানুষ হিসেবে সেটাই কামনা করি।
ডা. আফরোজ হেলালী
চিকিৎসক
স্পিচ আ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাথলজিস্ট
Comments